
এক বর্ষায় বাবার চাকরি চ’লে যায়। আমি তখন ছয় বছর। আর এই
ভেবে অবাক হই বাবার মনে আনন্দ নাই! দুর্ভাগ্যের চূড়ায় দাঁড়ানো
আমার বোকা বাবা হাসতে ভুলে যান। আর আমার সিরিয়ালপ্রিয় মা
হুট করেই সেলাই প্রেমী হ’য়ে ওঠেন। প্রতিবেশীদের সব জামা সেলাই
করতে করতে মা বদলে যান। মায়ের সবগুলো দিন আর সমস্ত প্রিয়
রাত ছিনতাই ক’রে নেয় একটি সেলাই মেশিন। সেলাই মেশিনটিকে
রূপকথার দৈত্য মনে হয়। আমাকে ঘুমের মধ্যে তাড়া করে আর আমি
শুনতে পাই একটি ভৌতিক হাসি— ঘট্ঘট্ ঘট্ঘট্। দুঃস্বপ্নরত আমার
ঘুম প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার ক’রে ওঠে। আমাকে আগলে নেয় একজোড়া
প্রিয় হাত। আনন্দে মা ব’লে গলা চড়তেই দেখি চাকরি খোয়ানো বাবা।
আজকাল যার অফিস নাই, খুব সকালের তাড়া নাই। বাজার ফেরত
রহস্যময় কাশি নাই, ব্যাগভর্তি হাসি নাই। বাবার কেনা মাছ মুরগী
দিনকে দিন বাচ্চা হয়। তাঁর লম্বা হাত ক্ষ’য়ে ক্ষ’য়ে অবাক নিয়মে আঙুল
প্রায়। আর আমাদের দুধওয়ালা কাকু দোতালাকে সযত্নেই পাশ কাটায়।
কলিংবেলটা বাজে কেবল তিন তালায়। অথচ দুধে আমার অরুচি নাই!
বাবা জানেন, মা-ও তা জানেন; আমিই কেবল ভুলতে চাই। ভাত রাঁধা
আর হাত পোড়ানো, রান্না ও লবন বাহুল্যতা, তীব্র ঝালের হা হুতাশ—
আমার চাকরীচ্যুত গৃহিণী বাবার সাম্প্রতিক ভুল। এক দুপুরে কাপড়
কাঁচতে থাকা আমার অসহায় বাবাকে দেখে আমার মা মনে হয় আর
সেলাইরত মা’কে মনে হয় কর্মব্যস্ত বাবাই। আর তখন আমার অসহ্য
লাগে। আমি দৌড়ে মায়ের কাছে যাই। মায়ের হাতে ও-পাড়ার ঝন্টুর শার্ট।
মা সেলাইয়ে ব্যস্ত। আমি মা’কে জড়িয়ে ধরি। মা আমাকে ছাড়িয়ে নেন।
যেন মায়ের সময় নাই। যেন ঝন্টুই মায়ের খুব আপন। আমার খুব কান্না
পায়। আমি বাতাসের গায়ে দুঃখ লিখি— হে ঈশ্বর, বাবাকে একটি চাকরি
দিন। বাবাকে ফের বাবা ক’রে দিন। প্রিয় মা’কে ফেরত দিন। আমার খুব
কষ্ট হয়! কষ্ট হয়! কষ্ট হয়!